৩৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অচল

Share on facebook
Share on whatsapp
Share on twitter
Share on linkedin

সর্বজনীন পেনশন ‘প্রত্যয়’ স্কিমকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে এটি প্রত্যাহারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় কলা অনুষদেছবি: দীপু মালাকার

পেনশন নিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল সোমবার থেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলছেন, সরকারের কারও পক্ষ থেকে (গতকাল রাত আটটা পর্যন্ত) আলোচনার কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তাঁরা আলোচনায় প্রস্তুত এবং দ্রুত ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়া শুরু করতে চান। কিন্তু দাবির সুরাহা না হলে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁদের উপায় থাকবে না।

আলোচনার প্রস্তাব দূরে থাক, কেউ একটা ফোন করে জানতে চাননি কেমন আছি।

অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলাম, সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আন্দোলনে নেমেছেন সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে। সরকার বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৪০০টির মতো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যয় কর্মসূচির আওতায় পেনশন দেওয়া হবে।

কর্মসূচিটি ১ জুলাই থেকে চালু হয়েছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বলছে, নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের সুবিধা কমবে। ব্যবস্থাটি বৈষম্যমূলক ও তাঁদের অবমাননাকর। তাঁরা নতুনদের জন্য এই আন্দোলন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দাবি তিনটি—প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার, সুপার গ্রেডে (প্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিবেরা যে ধাপে বেতন-ভাতা পান) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি শুধু প্রত্যয় স্কিমের প্রজ্ঞাপন বাতিল।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলোচনার প্রস্তাব দূরে থাক, কেউ একটা ফোন করে জানতে চাননি কেমন আছি।’
কর্মবিরতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গতকাল ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিল। দু-একটিতে নির্ধারিত পরীক্ষা হয়েছে। তবে আজ মঙ্গলবার থেকে তা-ও বন্ধ থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কার্যক্রমে থাকা ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশে এখন কার্যক্রমে থাকা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি। সেখানে শিক্ষক রয়েছেন ১৬ হাজারের কিছু বেশি। কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ৩৪ হাজারের মতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল সকাল থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হয়। ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ছিল। আগের দিন এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গতকাল সকালে দেখা যায়, ক্লাস, পরীক্ষার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও বন্ধ রাখা হয়েছে।

সর্বাত্মক কর্মবিরতির মধ্যে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়। আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিনাত হুদা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এতে অনুপস্থিত ছিলেন। তবে সমিতির নেতাসহ শিক্ষকদের অনেকেই টিএসসিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে অংশ নেন।

নিজামুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অসুস্থ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদও কর্মবিরতি পালন করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আমরা তিন মাস ধরে আন্দোলন করে আসছি। প্রথমে মানববন্ধন করেছি; এক ঘণ্টার কর্মবিরতি, দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি দিয়েছি। পরে অর্ধদিবস, পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছি। তখন পরীক্ষা চলমান ছিল। কিন্তু আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের ভালোর জন্য আমরা আন্দোলন করছি। কারণ, আমাদের যেটুকু সুবিধা ছিল, সেটুকু বাতিল হলে এই পেশায় আর মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসবে না। মেধাবীরা শিক্ষকতায় না এলে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতির অংশ হিসেবে গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এতে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক সরকার বলেন, প্রত্যয় কর্মসূচি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন করছেন শিক্ষকেরা। এর অংশ হিসেবে গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনসংলগ্ন আমতলায় অবস্থান কর্মসূচিও পালন করেন তাঁরা। শিক্ষকেরা বলেন, সরকার দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ সময় সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
শুভবুদ্ধির উদয় চায় সমিতি

অর্থ বিভাগ গত ১৩ মার্চ প্রত্যয় কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর তা পর্যালোচনার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। কমিটি একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন কর্মসূচিতে শিক্ষকদের সুবিধা কমবে।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, চূড়ান্ত বিচারে কারও সুবিধাই কমবে না। প্রত্যয় চালু হলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আর মেধাবী ব্যক্তি সব শ্রেণি-পেশাতেই আছেন।

শিক্ষকেরা বলছেন, প্রত্যয় কর্মসূচির অনেক কিছুই অস্পষ্ট। সেগুলো স্পষ্ট করা দরকার। যেমন একজন অধ্যাপক অবসরের পর ৮১ লাখ টাকার মতো গ্র্যাচুইটি বা আনুতোষিক পান। সেটা থাকবে কি না, তা জানা নেই। শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। নতুন ব্যবস্থায় ৬০ বছর পর থেকে পেনশন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। কিন্তু সরকারের কেউ কিছু বলছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। কিন্তু কেউ আলোচনার কথা বলছে না। তিনি বলেন, ‘কারও শুভবুদ্ধির উদয় হবে না!’

মন্তব্য করুন